মানসিক রোগ কী ?
মানসিক রোগ হচ্ছে মনের অসুখ। শরীর ও মন নিয়েই মানুষ। মানুষের শরীরের যেমন অসুখ হয়, মনেরও তেমনি অসুখ হয়। শরীরের অসুখ আমরা সহজেই মেনে নিই। কিন্তু মনেরও অসুখ হবে- ব্যাপারটা আমরা ঠিক মানতে পারি না। আমরা মানতে পারি বা না পারি, মনের যে অসুখ হয় এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। এই মনের অসুখের স্বরুপ কী? আমরা ঠিক কোন অবস্থাকে মনের অসুখ বলবো ?
কোনো মানুষের চিন্তা ও আচরণে হালকা থেকে মাঝারি বা তীব্র ধরনের সমস্যা হওয়ার কারণে যদি তার নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়, তিনি যদি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেন, এই অবস্থাটিকে আমরা মানসিক অসুস্থতা বলতে পারি। এই অবস্থায় মানুষটি তার চিন্তা ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খান বা হারিয়ে ফেলেন। আপনার চিরপরিচিত মানুষটি হয়ে যান অন্য কোনো মানুষ। মানসিক রোগ হলে অভ্যাস, ব্যক্তিত্ব, মেজাজ, চিন্তা সবকিছুই প্রভাবিত হয়। সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। এই পর্যন্ত প্রায় দুইশরও বেশি ধরনের মানসিক রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ডিপ্রেসন, এংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার প্রভৃতি সবচেয়ে বেশি ঘটতে দেখা যায়। মানসিক রোগ শারীরিক ও আবেগীয় দিককেও প্রভাবিত করে।
মানসিক রোগ কেন হয় ?
অতিরিক্ত মানসিক চাপ, প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার প্রভাব প্রভৃতি কারণে সাধারণত মানসিক রোগ হতে দেখা যায়। এছাড়া জিনগত কারণে এবং শরীরের জৈবরাসায়নিক ভারসাম্যহীনতাকে মানসিক রোগের জন্য দায়ী ভাবা হয়।
মানসিক রোগের উপসর্গ
বিভিন্ন রোগের উপসর্গ বিভিন্ন রকমের হয়। তবে সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক, কিশোর-তরুণ, বৃদ্ধদের নিচের উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে।
- চিন্তাভাবনায় সমস্যা
- দীর্ঘদিন হতাশায় ভোগা
- মন-মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন
- অতিরিক্ত ভয় ও দুশ্চিন্তা
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
- খাদ্যগ্রহণ ও ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন
- তীব্র রাগ
- ভুল, অদ্ভুতুড়ে বিশ্বাস (delusion)
- ভুল দেখা, ভুল শোনা (hallucination)
- দৈনন্দিন জীবনের খেই হারিয়ে ফেলা
- আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা
শিশুদের ক্ষেত্রে
- স্কুলের ফলাফলে আকস্মিক পরিবর্তন
- অনেক চেষ্টা করেও ভাল ফলাফল করতে না পারা
- খাদ্য ও ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন
- অতিরিক্ত চাঞ্চল্য বা নিথর হয়ে যাওয়া
- ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা
- খুব বেশি রাগারাগি করা
মানসিক রোগের চিকিৎসা
আপনার যদি মানসিক রোগ হয় তাহলে কী করবেন? চমকে গেলেন তো? খুবই স্বাভাবিক। আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধারণা প্রচলিত আছে যে 'আমার কখনো মানসিক রোগ হবে না। আমি এবং আমার প্রিয় মানুষগুলো এই বিদঘুটে রোগগুলো থেকে পুরোপুরি নিরাপদ'। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে যে এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপনি বা আপনার কাছের কেউই যেকোনো সময় যেকোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। এতে লজ্জার কিছু নাই। এটা কোনো দুর্বলতাও নয়। তাই আপনার মধ্যে যদি কখনো মানসিক রোগের উপসর্গগুলো দেখা দেয় তাহলে প্রথমেই যা করবেন তা হলো সকল উন্নাসিকতা ঝেড়ে ফেলে মেনে নিন যে, আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তারপর বিশ্বস্ত কারো সাথে পরামর্শ করতে পারেন, কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আপনার জন্য ভাল হবে। তারপর সোজা তার চেম্বারে যাবেন।নিজে সমাধানের চেষ্টা করবেন না, সমাধান খুঁজুন সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে।
তিনি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিলে ওষুধ খাবেন। যা করতে বলবেন সেই কাজগুলো গুরুত্বের সাথে করবেন। এছাড়া দক্ষ কোনো সাইকোলজিস্টের সান্নিধ্যে সাইকোথেরাপি নেয়াও দারুণ উপকারী। আপনার চিকিৎসা কী হবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার রোগের তীব্রতার উপর। তীব্রতা বেশি হলে সাধারণত ওষুধ দেয়া হয়।
আর ওষুধ লিখেন মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ। সাইকোলজিস্টরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করে থাকেন। তারা চিকিৎসা করেন কথা বলে বা আলোচনা করে আপনার সমস্যা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে।
সাইকোথেরাপিও উপকারী ।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে চিকিৎসা নেওয়া - সবই গুরুতর লজ্জা এবং অপরাধের কাজ। এই ঘটনাগুলো ঘটলে আপনাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে। পরিবারের সহযোগিতাও হয়ত সবসময় পাওয়া যাবে না। সেজন্য হতাশ হবেন না, নিজের সমস্যাকে অবহেলা করবেন না।
বিশ্বাস করুন, আপনি যদি সমস্যা ক্ষুদ্র থাকতে চিকিৎসা গ্রহণ না করেন, তাহলে রোগের তীব্রতা অবশ্যই বেড়ে যাবে। তখন সমাজ, পরিবার কাউকেই পাশে পাবেন না। কেউ কেউ হয়তো সহযোগিতাপ্রবণ পরিবার পেয়ে থাকেন, তবে বেশিরভাগই ততটা সৌভাগ্যবান নন। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর কথা বললে একশ্রেণীর মানুষ ক্ষেপে যান। তাদের প্রতিক্রিয়া, 'হ্যাঁ, আমি কি পাগল হয়েছি যে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবো?' তাদের কাছে মানসিক রোগ মানেই পাগল হওয়া।
তাহলে পাগল হওয়া কাকে বলে? মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলা, ছেঁড়া জামাকাপড় পড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। আর সাইকিয়াট্রিস্ট মানে এদের ধরে বেঁধে রেখে যারা চিকিৎসা করেন। এমন ভাবনা যাদের, তাদের জানা উচিত, মানসিক রোগ মানেই পাগল হওয়া না। মানসিক রোগ মানসিক চিন্তা ও আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন যা ব্যক্তির ক্ষতি করছে। এই ক্ষতি ঠেকাতে সাইকিয়াট্রিস্ট ব্যক্তিকে সহযোগিতা করেন। আমাদের দেশে আরেকটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, ধর্ম মেনে চললে মানসিক রোগ হয় না। কিন্তু মানসিক রোগ ধার্মিক-অধার্মিক মেনে হয় না।
যদিও ধার্মিক লোকদের মানসিক সেবা নেয়ার প্রবণতা থাকে। আপনি যখন মানসিকভাবে সুস্থ তখন ধর্ম মেনে চললে আরো ভাল থাকতে পারবেন। কিন্তু যখন অসুস্থ হয়ে পড়বেন তখন ধর্মীয় বিধিবিধান মানার মতো অবস্থাই থাকে না। সেই অবস্থায় অবশ্যই আপনি ধর্ম মানার চেষ্টা করবেন। তবে রোগের জন্য চিকিৎসাও নিতে হবে।
মানসিক রোগ সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
প্রিয় কারো মৃত্যু, চাকরি হারানো, সম্পর্কচ্ছেদ, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর। এতে আমরা ভেঙে পড়ি, কষ্ট পাই, দিনের অনেকটা সময় মন খারাপ করে বসে থাকি। কিন্তু কোনো ঘটনায় তীব্র আঘাত পাওয়াজনিত শোক বা শুধুই মন খারাপকে হতাশা বা ডিপ্রেশন বলে না। ডিপ্রেশন তখনই বলা যাবে যখন একইসাথে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র মন খারাপ থাকবে, আপনি তীব্র হীনমন্যতায় ভুগবেন, এককালের প্রিয় ও পছন্দের কাজেও মনোযোগ দিতে পারবেন না, সবকিছু অসহ্য লাগবে, জীবনটা অর্থহীন মনে হবে, আত্মহত্যার চিন্তা করবেন, এমনকি সেই চেষ্টাও করবেন। হতাশায় আক্রান্ত ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস অসম্ভব কমে যায়। ফলে তিনি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজগুলোও করতে পারেন না।
হতাশার তলদেশে;
এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন হয়তো তাকে অলস, অকর্মার ধাড়ী, ঢং করছে প্রভৃতি নানা তিক্ত কথা বলবেন। অযাচিত উপদেশ দিবেন, বোঝাবেন। কিন্তু এতেও আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হবে না। এই 'হালকা' ডোজ কাজ করছে না বলে তারা কঠিন অ্যাকশনে যাবেন। হয়তো বিরক্ত হয়ে রাগারাগি করবেন তারা, গালাগাল করবেন। কিন্তু এরা একবারও ভাববেন না এই লোকটি কিছুদিন আগেও ভাল ছিল, পরিশ্রমী ছিল।
এখন হঠাৎ পরিবর্তন হলো কেন? তারা বকাবকি করে আর জ্ঞান দিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করতে চান, একবারও ভাবেন না যে তিনি মানসিকভাবে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আপনি যদি এমন অবস্থার শিকার হন বা এমন অবস্থা দেখে থাকেন তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন বা দিন। ভেবে দেখুন, আক্রান্ত ব্যক্তি এমনিতেই তীব্র মনোকষ্টে ভোগেন, পরিবারের লোকজনের খারাপ আচরণ তাকে কতটা কষ্ট দেবে। এ অবস্থায় তিনি হয়তো সামগ্রিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন।
আপনার আচরণে কষ্ট পেয়ে কেউ যেন আত্মহত্যার পথ বেছে না নেয়;
পরিবারের সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ একান্ত জরুরী। একজনকে নিরীহ মানুষকে স্রেফ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে মেরে ফেলার অধিকার অবশ্যই কারোর নেই।
এংজাইটি ডিসঅর্ডার
এংজাইটি ডিজঅর্ডার বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জেনারালাইজড এংজাইটি ডিজঅর্ডার, সোশ্যাল এংজাইটি ডিজঅর্ডার, প্যানিক ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার প্রভৃতি সব রোগই এংজাইটি ডিজঅর্ডারের মধ্যে পড়ে। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের ব্যাপ্তি বেশ বড়। তাই এটা নিয়ে আলাদা আলোচনা থাকবে। তো এংজাইটি ডিজঅর্ডার কথাটা শুনলে সাধারণ মানুষ মনে করে দুশ্চিন্তা করা, যেটা চেষ্টা করলেই দূর করা যাবে।
আক্রান্ত ব্যক্তি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন বা ভয় পাচ্ছেন। দুশ্চিন্তা বা ভয় তো জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। তাই হয়তো অনেকে ভাবেন, আমিও দুশ্চিন্তা করি, আমিও ভয় পাই। এটাকে এত পাত্তা দেয়ার কী আছে। তারা বোঝেন না, ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক, দুশ্চিন্তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ভয় বা দুশ্চিন্তা মাত্রা ছাড়ালে তা বিপদের কারণ হয়। তখন সেটা আর স্বাভাবিকভাবে ঝেড়ে ফেলা যায় না, সেটা হয়ে পড়ে একটা মেডিক্যাল ক্রাইসিস। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে।
এংজাইটি ডিজঅর্ডারের বেশ কিছু শারীরীক উপসর্গও দেখা যায়। যেমন- মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, মাথা থেকে গরম ভাপ ওঠা, হাত-পা কাঁপা, ঘেমে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে হার্ট ডিজিজ। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়লো না। তখন বুঝতে হবে এটা প্যানিক ডিজঅর্ডার। তখন আর কার্ডিওলজিস্টের চেম্বারে ঘোরাঘুরি না করে সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে যেতে হবে। আবার কেউ সামাজিক পরিবেশে মিশতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না। তাকে বকাঝকা না করে ডাক্তার দেখানো অপরিহার্য। চিকিৎসায় এই রোগগুলো সেরে যায়। তাই দয়া করে এরকম অবস্থাগুলোকে অবহেলা করবেন না। অবশ্যই চিকিৎসা নিন।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার জটিলতম মানসিক রোগগুলোর একটা। ভুল বিশ্বাস, ভুলভাল দেখা, গায়েবী আওয়াজ শোনা, নিজেকে আঘাত করা ইত্যাদি এই রোগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কাল্পনিক এক জগতে বাস করেন। তাই তার চিন্তা ও আচরণে ভিন্নতা খুবই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এদেরকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়। এই রোগীদেরই মূলত 'পাগল' বলা হয়। তবে বেশিরভাগ রোগীরই সমস্যা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে এবং তারা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন নন। ভাল চিকিৎসা করলে স্কিৎজোফ্রেনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
Prepared by : Imtiaz Khandoker