গত ক'বছর ধরে বাংলাদেশকে আরও একটি ভাইরাসজনিত মহামারী রোগের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এটি হলো ডেঙ্গুজর। গত শতাব্দীতেও এ অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। মাঝের বছরগুলোতে এ রোগটি খুব একটা দেখা যায়নি। আবার নতুন করে এর আক্রমণে বেশকিছু মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। জনসচেতনতা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাসটির বাহক হলো একটি মশা। প্রধানত এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের দেহ থেকে জীবাণু নিয়ে তার কামড়ের মাধ্যমের অন্য সুস্থ (আপাত) মানুষকে সংক্রমিত করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিউলেক্স মশাও ডেঙ্গুর জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। তবে প্রধান বাহক এডিস মশা দিনের বেলাতেই শুধু মানুষকে কামড়ায় এবং ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটায়। এডিস মশার আরও স্বাতন্ত্র্য হলো এরা আবদ্ধ ছোট ছোট জলাধারে বংশ বৃদ্ধি করে। শহরাঞ্চল এদের খুব প্রিয়। শহরে বাসাবাড়ির ফুলের টবে, ফুলদানিতে, ফ্রিজে বা এয়ার কন্ডিশনারের ট্রে বা কোন কৌটা বা ডাবের খোসার জমা জলে এরা ডিম পাড়ে এবং এ ডিম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে ওঠে। ডেঙ্গু প্রধানত অভিজাত নাগরিকের অসুখ। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা কাউকে কামড়ানোর এক সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণগুলো নিম্নরূপ - উচ্চ তাপমাত্রা (১০৪ ফাঃ বা তারও বেশি), মাথাব্যথা, চোখের পেছন দিকে ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা ও তীব্র হাড় ব্যথা।
এসব কয়েক দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যেতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরের জটিলতা সাধারণত জ্বর ছাড়ার পরই শুরু হয়। তাই জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরও কমপক্ষে তিন দিন রোগীকে বিশ্রামে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু যদি ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণযুক্ত ডেঙ্গুজ্বর হয়, তবে উপরের বর্ণিত লক্ষণগুলোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন- ত্বকের নিচে, মাড়ি দিয়ে, নাক দিয়ে এবং বমি বা পায়খানার সঙ্গে। রক্তপাত বেশি হলে বা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে রোগীর শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয়। কারও কারও রক্তের প্লাটিলেটও দেওয়া হয়। ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যুহার খুব বেশি না হলেও ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভাবে কারও কারও মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এদের বেলায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরে রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা করলেও চলে। রোগীর শারীরিক সমস্যা বিবেচনা করে চিকিৎসা দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে থাকবে। তবে ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ শুরু হলে বা কোনো জটিলতা দেখা দিলে কোনোরূপ ঝুঁকি না নিয়ে রোগীকে ত্বরিত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া সহজ হয়। বাড়িতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু জিনিস খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে। ১. ডেঙ্গুজ্বরে শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই শুধু ব্যবহার করা যাবে। ২. ডেঙ্গজ্বরের রোগীকে সবসময় মশারির নিচে থাকতে, অন্যথায় তার দেহ থেকে জীবাণু মশাবাহিত হয়ে অন্য কাউকে আক্রান্ত করতে পারে। ৩. ডেঙ্গুজ্বরের রোগী সব ধরনের খাবারই খেতে পারবে। তবে জলীয় খাদ্য বেশি খেতে হবে। একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো- আমাদের চারপাশের সুস্থ সবল মানুষদের মাঝে অনেকেই হয়তো কোনো এক সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা আবার স্বাভাবিকভাবেই সেরেও উঠেছেন। রক্তের পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়। সুতরাং ডেঙ্গু নিয়ে ভয় নয়, হতে হবে সতর্ক। কারণ প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Collected from : বাংলাদেশ প্রতিদিন